“রাজনীতি আর প্রেম”
কবির সুমন
জনৈক এক রাজনীতিক বলে গেছেন,”রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।” তার এই উক্তি সবার কমবেশি জানা।আগের দিনের শ্রদ্ধাবোধ, শিষ্টাচার নাই বল্লে চলে, কর্মী থেকে নেতা বেশি, দলের ট্রেড মার্ক মুখ্য, মায় মমতা নর্দমায়, আস্তাকুঁড়ে কান্না, হারানোর বেদনা। স্বার্থের কাছে পদদলিত আবেগ। মায়া মমতা বৃথা।নীতি আদর্শ বাদ দিয়ে একে অপরকে দলে ঢুকায়, স্বার্থ হাসিলের অভিনব কায়দা কানুন অমৃত, গুলো অব্যাহত। যেনো প্রেম করে ছ্যাকা দেয়ার মতো।
এ ভাবনায় লোকাল ট্রেনে জানলার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র । তার মন খুব ভালো । আজকে আরেকটা মেয়েকে ছ্যাঁকা দিতে পেরেছে । এই নিয়ে সতের জন হলো । মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করে কয়েকদিন পর তাকে ছ্যাঁকা দেওয়ার মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে পায় সে । কিন্তু আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও সে এমন ছিলো না । একটা মেয়েকে সে ভীষণ ভালোবাসতো। তাকে নিয়ে পুরোটা জীবন থাকার স্বপ্ন দেখেছিল সে । কিন্তু মেয়েটি তার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । সেই থেকে মেয়েদের প্রতি তার ভীষণ ঘৃণা ।
কলি ফোন হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছে আর বারবার রুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করছে । প্রায় সাতচল্লিশ বার ডায়াল করার পর রুদ্র ফোন ধরলো ।
– প্লীজ রুদ্র, প্লীজ, তুমি এমন কোরো না। হাউমাউ করে কেঁদে বলল কলি ।
– আমি কেমন করছি ? অবাক হওয়ার ভান করলো রুদ্র ।
– ফোন ধরছো না আমার ।
– তোমার সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে । আমি কেনো তোমার ফোন ধরবো ?
– প্লীজ ,একটু বোঝার চেষ্টা করো । আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না ।
– আমার কিছু করার নেই । ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল রুদ্র ।
– তাহলে অন্তত একবার আমার সাথে দেখা করো । শেষবারের মতো। আর কোনোদিন কোনো অনুরোধ করবো না ।
– ঠিক আছে । কালকে বিকেলে দেখা করবো । কিন্তু মনে রেখো এটাই শেষ ।
ফোন রেখে দিল রুদ্র ।
পরদিন রাত ৯ টা :
সারাদিন ক্লাসের পর বাড়িতে ফিরে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো রুদ্র । ক্লাসের এক ফাঁকে কলির সাথে দেখা করে এসেছে । একদিনেই যেনো মেয়েটার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে । সারারাত কেঁদেছে বোঝাই যাচ্ছিল । রুদ্রের হাতে একটা প্যাকেট দেয় কলি ।
– প্যাকেটের ভেতর কি আছে ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রুদ্র ।
– রাতে খুলে দেখো । বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে কলি ।
প্যাকেটটার কথা মনে হতেই হাত বাড়িয়ে ব্যাগের চেন খুলে প্যাকেটটা বের করে আনল । প্যাকেটের মোড়ক খুলে বুঝতে পারে যে এটা কলির ডায়েরী । খুব অবাক হয় রুদ্র । বিছানার কোণায় বসে একটার পর একটা পাতা উল্টাতে থাকে রুদ্র । যতই পাতা উল্টাতে থাকলো তার শ্বাস প্রশ্বাস ততোই গভীর হতে থাকলো । ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় তার প্রতি কলির ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে । উল্টাতে উল্টাতে শেষ পাতায় এসে পড়লো । সেখানে লেখা আছে , ” তুমি যখন ডায়েরীটা পড়বে তখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে থাকবো । আর কোনদিনই তোমাকে বিরক্ত করবো না । ভালো থেকো। ”
কথাটার মর্মোদ্ধার করতে কষ্ট হলো না রুদ্রের । তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে কলির নাম্বারে ডায়াল করলো । কিন্তু নাম্বার বন্ধ । পাগলের মতো কলির এক বান্ধবীর মোবাইলে কল করলো । অনেকবার কল করার পর ধরলো সে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কলির মৃত্যুর কথা জানাল সে । বাকরুদ্ধ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো সে ।
এই হলো প্রেম!
কয়েক মাস পর :
খুব স্মৃতিময় একটা জায়গায় বসে আছে রুদ্র । প্রায় সময়ই এই জায়গায় এসে বসে থাকে সে । সে আর কলি এখানে প্রথম দেখা করেছিল । পাঁচ মাসের রিলেশনে মাঝে মাঝেই এখানে দেখা করতো তারা । রুদ্র বুঝতেই পারেনি কলি তাকে এতটা ভালবেসেছিল । মেয়েদের প্রতি তার ঘৃণার কারনেই হয়তো তখন বুঝতে পারেনি । আর কোনো মেয়ের সাথে না জড়িয়ে পুরোটা জীবন কলির স্মৃতি নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে । সিদ্ধান্তটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেনি কখনও ।
হঠাৎ করে কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাল । ভূত দেখার মত চমকে উঠলো সে! কলি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে ।
– এটা কীভাবে সম্ভব ? আমি ভুল দেখছি না তো? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো রুদ্র ।
– না, তুমি ভুল দেখছো না । আমি মরিনি । কখনও মরার চেষ্টাও করিনি ।
– তাহলে তোমার বান্ধবী যে বলল ?
– তাকে আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম কি বলতে হবে তোমাকে । মুচকি হেসে বললো কলি ।
– কিন্তু এইসব কেন করলে?
– আমি যখন উল্টো পাল্টা একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নেই তখনই তোমার একটা বন্ধু কোথা থেকে জানি আমার নাম্বার জোগাড় করে আমাকে ফোন করে । তোমার অতীত ইতিহাস সব খুলে বলে আমাকে । তুমি যে শুধু একটা মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রেম করো সেটা আমি জানতে পারি। আমি তোমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নেই । এই কয়েক মাস আড়ালে থেকে অন্যদের কাছ থেকে তোমার খোঁজ–খবর নিতাম।তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে সংশোধন করেছো । এই কাজটা না করলে হয়তো তোমাকে কখনও এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যেত না ।
কোন কিছু না বলে কলির দিকে তাকিয়ে থাকলো সে ।
– পৃথিবীর সব মানুষ এক না । একজনের অপরাধের জন্য নিরপরাধ অন্য আরেকজনকে শাস্তি দেওয়া উচিত না ।
হয়তো তোমার কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে অনেক মেয়েই ছেলেদের প্রতি প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে পড়েছে।তার জন্য তো তুমি দায়ী থাকবে ।
– হুম, কিন্তু যতই নিজেকে সংশোধন করি না কেনো আমার ইতিহাস জানার পর তো আমাকে আর ভালবাসার কথা না ।
– একটা মানুষ যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয় তাহলে তাকে ক্ষমা করা উচিত । আমার মুখ দেখেও কি বুঝতে পারছ না আমি কি চাইছি ? হেসে বললো কলি ।
সম্মোহিতের মতো কলির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো রুদ্র । সেই চোখে তার জন্য ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হল না রুদ্রের । নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো তার।
তাই প্রেমে শেষ বলে কথা নেই!আর -“রাজনীতিতে তো শেষ কথা বলে কিছু নেই।”
Leave a Reply